আজ ২৯শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১৪ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী আন্দোলন-সংগ্রামের প্রেরণা


সৈয়দ শিবলী ছাদেক কফিল: উপমহাদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিক, সর্বজন নন্দিত মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী একজন প্রাতঃস্মরণীয় মানুষ। উপমহাদেশের ইতিহাসে কালজয়ী এ মহাপুরুষ, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের কিংবদন্তী নেতা, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, এদেশে বাংলায় প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকার প্রথম মুসলমান সম্পাদক, চট্টগ্রাম শহরের কদম মোবারক মুসলিম এতিমখানা, কদম মোবারক এম ওয়াই উচ্চ বিদ্যালয় ও চন্দনাইশের বরকল শামসুজ্জামান (এস জেড) উচ্চ বিদ্যালয়েরর প্রতিষ্ঠাতা, বঙ্গীয় আইন পরিষদের প্রাক্তন সদস্য ছিলেন এই মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী।

এই ইসলামাবাদী ছিলেন একাধারে শিক্ষক, সাংবাদিক, সংগঠক, বিপ্লবী, সমাজ সংস্কারক ও লেখক। তিনি চট্টগ্রামের দেয়াং পাহাড়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণপন চেষ্টা করেছিলেন। এজন্য পাহাড়ের ভুমি মালিকানাও দান করেছিলেন। বরেণ্য মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ১৮৭৫ ইংরেজি সালের ২২ আগস্ট চট্টগ্রামের চন্দনাইশ (তৎকালীন পটিয়া) থানার ২০ নম্বর বরমা ইউনিয়নের আড়ালিয়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। মতিউল্লাহ পন্ডিত তাঁর পিতা ও রহিমা বিবি তাঁর মাতা।

চিরবিপ্লবী নেতা ছিলেন তিনি। প্রথম দিকে তিনি অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনে সক্রিয় থেকে কারা বরণ করেছিলেন। তিনি তখন পাঞ্জাবের মানওয়ালী জেলে আটক ছিলেন। তিনি এক সময় চট্টগ্রাম মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন তবে পরে নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতিতে যোগদান করেন। ১৯৩৯ সালের ১১এপ্রিল কলকাতা মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে মৌলভী এসোসিয়েশনের দ্বি-বার্ষিক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন ইসলামাবাদী।

তিনি বিত্তশালী পরিবারের সন্তান হয়েও এসলামাবাদীর রাজনৈতিক জীবনের লক্ষ্য ছিল গরীব দু:খী মানুষের দুঃখ মোচন। তিনি ১৯৩৭ সালে কৃষক প্রজা পার্টির টিকেটে নির্বাচিত হয়েছিলেন। পার্টির ২২ জন পরিষদ সদস্যের মধ্যে মাওলানা ব্যতীত অন্যদের মধ্যে ছিলেন আবু হোসেন সরকার, শামসুদ্দীন জালাল উদ্দীন হাশেমী, সৈয়দ নওশের আলী, হুমায়ূন কবির প্রমুখ।

মাওলানা এসলামাবাদী যে কোন মূল্যে স্বদেশের স্বাধীনতা অর্জনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। এজন্য কংগ্রেসের ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী হিসেবে কাজ করেন। তিনি দেশের আজাদীর জন্য সশস্ত্র সংগ্রামেরও পক্ষপাতী ছিলেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় নেতাজী সুভাষ বসুর নেতৃত্বে যখন আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠিত হয়। তখন তিনি নিজের জীবন বিপন্ন করেও সে ফৌজকে করেন সম্ভাব্য সর্বপ্রকার সাহায্য।

১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী কংগ্রেসে যোগদান করেন, এরপর মুসলিম লীগেও যান। কিন্তু কৃষক প্রজা পার্টিতেই তাঁর রাজনীতি একটি লক্ষ্যবিন্দুতে পরিণত হয় এবং নেতাজীর আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগদানের মাধ্যমে তার চুড়ান্ত পরিনতি। তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারার উত্থান-পতনের অন্তরালে মূলকথা সর্বদা এক ও অভিন্ন ছিল। তাঁর।স্বপ্ন ছিল মুক্ত ভারতে মুসলমানদের উত্থান। আর এর প্রথম শর্ত বৃটিশ খেদানো। কংগ্রেস বা মুসলিম লীগ এর উপর অনেকটা আস্থাহীনতার জন্যই নেতাজী সুভাষ বসুর আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন তিনি।
ইসলামাবাদী শুধু খিলাফত আন্দোলনেই সক্রিয় অংশ নেননি, ১৯০৮ সালে লিবিয়ায় ত্রিপলী যুদ্ধ ও ১৯২২ সালে বলকান যুদ্ধের সময় তিনি দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। সুভাষ বসুর চট্টগ্রাম সফরকালে পটিয়ার দেয়াঙ পাহাড়ে ইসলামাবাদীর সাথে গোপন বৈঠক করেন। ইসলামাবাদী ঐখানে বিশাল জায়গা স্বজাতীয় ছাত্রদের জন্য ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় করার জন্য দান করেছিলেন। ১৯৪২-৪৩ সালে স্বাধীনতার মন্ত্রে পূর্ণদীক্ষিত ইসলামাবাদী নেতাজীর সশস্ত্র আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন।ইসলামাবাদী চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড এলাকায় বিপুল পরিমাণ জায়গা জমি নিয়ে বৃটিশ খেদাও আন্দোলনের একটি গোপন দূর্গ স্থাপন করেছিলেন। এখানে স্থাপিত হয়েছিল একটি খামার বাড়ি। এ খামার বাড়ি থেকেই তিনি নেতাজীর আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতা ও কর্মীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন এবং তাঁদেরকে আর্থিক সাহায্য দিতেন। স্বয়ং নেতাজী সুভাষ চন্দ্রেরও এ খামার বাড়ির সাথে যোগাযোগ ছিল। আরেকটি ঘাঁটি স্থাপনের উদ্দেশ্যে কিছু আত্মীয়-স্বজনের সহযোগিতায় চকরিয়া থানার বদরখালী মৌজায় সমুদ্র সংলগ্ন অঞ্চলে তিনি আরেকটি খামার স্থাপন করেছিলেন। এ খামার স্থাপনের মাধ্যমে তিনি চেয়েছিলেন স্বল্প সময়ে যোগাযোগ রক্ষা এবং নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে। তাঁর বংশের অনেকে এখনও সেখানে আছেন। পরবর্তী কালে কারারুদ্ধ হওয়ায় সে জমি তাঁর হাত ছাড়া হয়ে যায়। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সাথে মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। দলমত নির্বিশেষে সকলের কাছে ইসলামাবাদী সম্মানের পাত্র ছিলেন। স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী ইসলামাবাদীকে অত্যন্ত সম্মান করতেন। একবার আসামে কংগ্রেস সম্মেলনে মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানীকে মাওলানা ইসলামাবাদী বেশ কিছু দুর অগ্রসর হয়ে অভ্যর্থনা জানান। আসামের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রবরদুলই এ বিষয়টির প্রতি মহাত্মা গান্ধীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। মহাত্মাগান্ধী হেসে প্রধানমন্ত্রী শ্রবরদুলকে বলেন, ‘‘মাওলানা ইসলামাবাদীর মন অনেক বড়, মাওলানা মাদানীকে সম্মান প্রদর্শনের অর্থ নিশ্চয় আমাদের কারো প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন নয়। “শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা দলের সহ-সভাপতি এবং বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদের উপ-নেতা হিসেবে সর্বদা তিনি শেরে বাংলাকে উত্তম পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করতেন। এখানে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে মাওলানা ইসলামাবাদী মুসলিম লীগে থাকাকালেও লীগের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি চট্টগ্রাম মুসলিম লীগের প্রথম সভাপতি ছিলেন।

ইসলামাবাদীর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভারত ছাড় আন্দোলনে যোগদান ও আজাদ হিন্দ ফৌজের কার্যক্রমের প্রতি সক্রিয়ভাবে সমর্থন করা। সে সময় তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজকে কার্যক্রমের প্রতি সক্রিয়ভাবে সমর্থন করেন। সে সময় তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজকে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামে বিপ্লবী কেন্দ্র স্থাপন করেন। নেতাজী যখন আজাদ হিন্দ ফৌজ নিয়ে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ দখল করে ভারতের ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকা উড়িয়ে ‘দিল্লী চলো’ শ্লোগান তুলে এগিয়ে চলছিলেন ভারতের দিকে ঐ সময় ইসলামাবাদীর সাথে পরিচয় ঘটে বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স এর সুবোধ চক্রবর্তীর। সুবোধের সাথে আলাপ করে ইসলামাবাদী এত বেশি মুগ্ধ হন যে শেষ বয়সে একটা ঝুঁকি নেয়ার জন্য রাজি হয়েছিলেন। সুবোধকে সঙ্গে নিয়ে তিনি চলে আসেন চট্টগ্রামের দেয়াং পাহাড়ে। চট্টগ্রামের পাহাড়-পর্বত ডিঙ্গিয়ে আরাকানের পথ ধরে আবারো নেতাজীর সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার লক্ষ্যে যখন পথ চলছিলেন তখন সীমান্ত এলাকায় ছিল সতর্ক পাহারা। আজাদ হিন্দ ফৌজ দখলে থাকার কারণে সতর্কতা খুবই প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

ইসলামাবাদী তখন তাঁর সহযোগীকে বলেছিলেন- আমার জীবনের মাত্র কয়েকদিন বাকি, এই চরম ঝুঁকি নিতে আমার অসুবিধেও নেই। তাই সিদ্ধান্ত নিয়ে ঝুঁকি নিলেন- শ্যালক মোরশেদকে নিয়ে একেবারে ফকির সেজে নেতাজীর সাথে তিনি সাক্ষাৎ করেছিলেন। ব্রিটিশ গুপ্তচরেরা তখন মাওলানার সমস্ত বিপ্লবী কর্মকাণ্ড বুঝতে পারে। সে কারণে তাঁর শহরস্থ বাড়ি, তৎকালীন পটিয়ার (বর্তমান চন্দনাইশ থানার) বরমা ইউনিয়নের আড়ালিয়া গ্রামে বাড়ি, সীতাকুন্ডের বাড়ি, কলকাতার বাসা ইংরেজ সার্জেন্টের নেতৃত্বে বিপুল সৈন্যের মাধ্যমে তল্লাশি চালানো হয়। ঐ সময় মাওলানাকে চট্টগ্রাম শহর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ব্রিটিশ সরকার মহাত্মা গান্ধী, পন্ডিত জহরলাল নেহেরু প্রমুখ নেতার সাথে ইসলামাবাদীকেও দিল্লীর লালকেল্লায় বন্দী করে রাখে। পরে তাঁকে সেখান থেকে পাঞ্জাবের মানওয়ালী জেলে স্থানান্তর করে। সেখানকার জেলে ছাদের বিমের সাথে দড়ি দিয়ে বৃদ্ধ মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর পা বেঁধে মাথা নিচের দিকে ঝুলিয়ে রেখে তাঁর উপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়েছিল।

মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী আপামর ভক্তজনতাকে শোক সাগরে ভাসিয়ে ১৯৫০ সালের ২৪ অক্টোবর ইন্তেকাল করেন। তাঁকে চট্টগ্রাম মহানগরীর কদম মোবারক এতিমখানা ও মসজিদের পাশে দাফন করা হয়।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই বিভাগের আরও খবর